শিক্ষকতা কোনো পেশা নয় বরং এটি একটি ব্রত

শিক্ষকতা কোনো পেশা নয় বরং এটি একটি ব্রত। এটিই শিক্ষকতা সম্পর্কে সম্যক ধারণা। তবে বাস্তবে এটিকে পেশা হিসেবেই গ্রহণ করা হয়। তবে আর দশটা পেশা থেকে এর দায়িত্ব ও উদ্দেশ্য ভিন্ন। একজন শিক্ষক কেমন হবেন? এসব বিষয় নিয়ে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। সেসব গবেষণা থেকে বেরিয়ে এসেছে একজন শিক্ষকের দায়িত্ব ও গুণাবলি।



খুব সাধারণভাবে বোঝালে যিনি তোমাকে একদিনের জন্যও কোনো বিষয়ের শিক্ষা প্রদান করেছেন তিনিই শিক্ষক। শিক্ষক, শিক্ষা ও শিক্ষার্থী শব্দগুলো পারস্পরিক নির্ভরশীল ও একে অপরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কযুক্ত। শিক্ষকবিহীন শিক্ষা যেমন কল্পনা করা যায় না তেমনি শিক্ষার্থীবিহীন শিক্ষাও অর্থহীন। শিক্ষক তার কাছে আসা শিক্ষার্থীদের জীবনে বেঁচে থাকার, জীবনযুদ্ধে জয়ী হওয়ার মন্ত্র শিখিয়ে দেন। তিনি শিক্ষার্থীদের মনের আবেগ নিয়ন্ত্রণের দীক্ষা দেন। তিনি চান যেন তার শিক্ষার্থী জীবনের সব প্রতিকূলতা পেরিয়ে বিজয়ী হোক। আবার একজন শিক্ষককে বলা হয় আজীবন ছাত্র। জ্ঞান অন্বেষণ তার তৃষ্ণা অপরিসীম। নিজে না শিখলে অন্যকে কী শেখাবেন। তাই তো তাকে পড়তে হয়, জানতে হয় এবং জানাতে হয়। জানানোর কাজটি হচ্ছে শিক্ষকতার জীবনের সব থেকে পরিশ্রমী এবং কঠিন কাজ। কারণ, তার জানানোর কাজটি সফল হয়েছে কিনা তা বুঝতে পারাও একটি বড় দক্ষতার ব্যাপার।

একজন শিক্ষক হচ্ছেন সেই ব্যক্তি যার মধ্যে পরামর্শক হওয়ার, শিক্ষা সহায়ক ব্যক্তি, শিক্ষক নিজেই শিক্ষা সহায়ক সামগ্রীর উন্নয়ন সাধন করবেন, তার আচরণ হবে রোল মডেল, তিনি সমাজের দর্পণ, কারিকুলাম প্রস্তুতকারক ও মূল্যায়নকরণ, শিক্ষা সংগঠক এবং নির্দেশক ইত্যাদি গুণাবলিসম্পন্ন মানুষ। সত্যি কথা বলতে একদিক থেকে শিক্ষক একজন সত্যিকারের অতিমানব যাদের থাকে সহজেই আকৃষ্ট করার ক্ষমতা। আবার একদিক থেকে শিক্ষকরা খুব সাধারণ একজন মানুষ যারা তৈরি করেন অসাধারণ সব মানুষ। শিক্ষা কোনো পেশা নয় বরং একটি সেবা। সমাজে অনেক সেবামূলক কাজ রয়েছে। এর মধ্যে শিক্ষা অন্যতম। শিক্ষা হচ্ছে একটি ব্রত। যে ব্রত দিয়ে তিনি তার ছাত্র-ছাত্রীর মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটান। শিক্ষকের এই কাজটির সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে রয়েছে দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ।

বাস্তবে বিভিন্ন কারণে আমাদের দেশের শিক্ষক সমাজ আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। কারণ পাস করা সার্টিফিকেটের জোরে যে কেউ শিক্ষকতা পেশায় ঢুকে পড়ছে কিন্তু সেই ব্যক্তি শিক্ষক হিসেবে কেমন তা যাচাই করার কোনো উপায় নেই। একজন শিক্ষক অবশ্যই সৎ ও নৈতিক চরিত্রের অধিকারী হবেন। কিন্তু সার্টিফিকেট মেধার মূল্যায়ন করলেও মনুষ্যত্বের মূল্যায়নের ক্ষমতা রাখে না। ফলে শিক্ষকতা পেশায় থেকেও নানা অনৈতিক কার্যকলাপে জড়িয়ে পরছে। এবং এজন্য শিক্ষক সমাজের প্রতি আঙুল উঠছে। তাছাড়া শিক্ষাকে পুঁজি তৈরির উপাদান হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে অনেকে। দেশে হাজার হাজার কিন্ডারগার্টেন গড়ে উঠেছে। নামিদামি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে নানা কারণে অতিরিক্ত টাকা আদায় করা হয়। বড় হওয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে অনেক শিক্ষকের সাহচর্যে এসেছি। তবে তাদের সবাই কিন্তু মনে ঠাঁই করে নেননি। কেউ কেউ আজও মনে দাগ কেটে রেখেছেন। প্রাথমিক পর্যায় থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কয়েকজন শিক্ষককেই আজও বারবার মনে পড়ে। সেসব শিক্ষকের আদর্শ নিয়ে এগিয়ে চলেছি। প্রকৃতপক্ষে পিতামাতার মত শিক্ষকের স্থানও তার সন্তানসম ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে। তার আদর্শই ভবিষ্যতে ছাত্রের মাঝে প্রভাবিত হয়।

শিক্ষক নিয়ে ছোটবেলাতে বাদশা আলমগীরের কবিতা পড়েছি। এই কবিতা আমরা সবাই পড়েছি। আমার খুব ভালো লাগত। শিক্ষকের মর্যাদা দেওয়ার উৎকৃষ্ট উদাহরণ এই কবিতা। পড়েছি এবং শিক্ষকদের নিয়ে কল্পনায় অন্যরকম উচ্চতায় চিন্তা করেছি। একজন বাদশা হয়ে যিনি শিক্ষকের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাশীল এবং শিক্ষকের প্রতি সন্তানের একটু অবহেলাও তিনি মেনে নিতে পারেননি। শিক্ষকের চিন্তাতেও যখন ওই অবহেলার বিষয়টি ছিল না তখন বাদশা তাকে বিষয়টি বলেন। তার যে এ বিষয়ও সন্তানের শিক্ষার মধ্যে আনা উচিত ছিল তা বোঝানোর জন্যই তিনি শিক্ষককে ডেকেছিলেন। আর তাই বাদশা আলমগীরকে কবিতায় মহান বলে বর্ণনা করা হয়েছে। যিনি সত্যিই বুঝেছিলেন শিক্ষকের মর্যাদা কেমন হওয়া উচিত। বছরের পর বছর পাস করিয়ে রেজাল্ট ভালো করাতে পারলেই কিন্তু শিক্ষকের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বরং দায়িত্ব তো প্রতিটি শিক্ষার্থীর মধ্যে লুকিয়ে থাকা সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটানো। একজন শিক্ষকই যা আবিষ্কার করতে পারেন এবং তা ব্যবহারে পথ দেখাতে পারেন। তবে বর্তমানে গুটিকয়েক শিক্ষকের কর্মকান্ডে

 প্রায়ই এ পেশা সমালোচিত হয়। কিন্তু গুটি কয়েক উদাহরণ থেকে সার্বিক মূল্যায়ন করাটা বোকামি। শুধু পেশায় নিয়োজিত হলেই শিক্ষক হওয়া যায় না। শিক্ষক হতে হলে তার সম্পর্কিত গুণাবলি অর্জন করতে হবে। শুধু পোশাকে বা পেশায় শিক্ষক হয়ে কী লাভ? বাবা মা যেমন সন্তানের বুকের ভেতর বেঁচে থাকে ঠিক তেমনি করেই শিক্ষক বেঁচে থাকেন তার শিক্ষার্থীর মধ্যে। আমার অনেক শিক্ষক যেমন আজও বেঁচে আছেন আমার মধ্যে।

শিক্ষক হিসেবে একজন মানুষ কখন সফল তা নির্ণয় তার চাকরির ওপর নির্ভর করে না। বরং সেই শিক্ষক কতজন শিক্ষার্থীর ভেতর নিজের আদর্শ প্রভাবিত করতে পারছেন, কতজনকে মানুষ হওয়ার সঠিক পথ দেখাতে পেরেছেন তার ওপর নির্ভর করে। শিক্ষক বেঁচে থাকেন শিক্ষার্থীর মধ্যে। মানুষ হওয়ার সেই মন্ত্র একমাত্র শিক্ষকের ভেতরেই থাকে। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষক সম্পর্কে নেতিবাচক মন্তব্য করার সুযোগই পাওয়া উচিত না। কারণ যে প্রকৃত শিক্ষক সে কোনোদিন কোনো একজন শিক্ষার্থীর জীবনে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এমন কিছু করেন না। শিক্ষকতা পেশায় থাকলেই প্রকৃত শিক্ষক হওয়া যায় না। এটাও এক ধরনের প্রাণান্ত চেষ্টার ফল। কোনো দেশের মেধাবী সন্তানরা বের হয় কোনো শিক্ষকের হাত ধরে।

শিক্ষকের আদর্শ, চেতনা, অনুপ্রেরণা, কর্মপদ্ধতি সবকিছু ছাত্র-ছাত্রীর মাঝে প্রভাবিত হয়। শিক্ষা যদি সমাজের আয়না হয় শিক্ষক তবে সেই আয়নার প্রতিচ্ছবি। শিক্ষকের মাধ্যমেই শিক্ষার রস সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষার রস আস্বাদন করার সুযোগ পায় শিক্ষকের জন্য। বর্তমান সময়ে শিক্ষকরা তাই অনেকটাই লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন। কেবল পেশা হিসেবেই নেওয়ার জন্য এই দশা। আর শিক্ষকতা ব্রত হিসেবে নেওয়ার জন্য কেবল সার্টিফিকেটের মানদ-ই যথেষ্ট নয়। সব থেকে কুৎসিত মানসিকতার মানুষেরও আজ বড় বড় সার্টিফিকেট রয়েছে। ভালো শিক্ষক হতে হলে সার্টিফিকেটের সঙ্গে সঙ্গে দরকার মানসিকতা। শিক্ষকতা পেশায় আসার আগে মনকে স্থির করতে হবে। কোন এক দুজন শিক্ষকরূপী অমানুষের জন্য শিক্ষক সমাজের অসম্মান মেনে নেওয়া যায় না। আর দশটা চাকরির যোগ্যতা আর শিক্ষকতার যোগ্যতা তাই এক মাপকাঠিতে বিচার করলে চলবে না।

অলোক আচার্য : শিক্ষক ও কলাম লেখক

Published by:

Informbd  +8801552505408

Post a Comment

Previous Post Next Post